বিশ্বজুড়ে এখন বড় আতঙ্কের নাম কোভিড১৯- বা নভেল করোনা ভাইরাস। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাস এর একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়ার পর থেকেই ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করে। ভাইরাসের কারণে মানুষ এখন অনেকটা গৃহবন্দী জীবনযাপন করছে।
ভাইরাসটি মহামারি আকার ধারণ করায় গত বছরের মার্চ থেকেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে করোনা কেবল সাময়িক প্রভাব ফেলেনি, এটি সৃষ্টি করছে শিখনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি।
বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে ইন্টারনেটকে। তবে সব স্তরের শিক্ষার্থীরা সমান সুবিধা পাচ্ছে না। অনলাইন ক্লাস কারও জন্য আশীর্বাদ, আবার কারও জন্য অভিশাপ। অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন সমস্যার কারণে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছে না। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ক্লাসের যথেষ্ট চাহিদা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে।
অনলাইন ক্লাস তাত্ত্বিক জ্ঞান মিললেও ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। করোনা শুরু থেকে দেশে যখন জরুরি অবস্থার পরিবেশ তৈরি হয়, তখন থেকে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ সিদ্ধান্তের আওতাভুক্ত করে বন্ধ করে দেয়। তখন অন্য সব ক্ষেত্রে একই অবস্থা জারি করা হয় যেন সংক্রমণ না ছাড়ায়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর ধীরে ধীরে সব সেক্টর চালু করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি গণপরিবহন ভাড়া ও স্বাভাবিক করা হয়েছিল। অথাৎ সীমিত কথাটি রইল না কোথাও।
কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেএে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন আসেনি। এর পিছনে কারণ কী? করোনা কি শুধু মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই? আর কোথাও নেই?
আমরা যারা চতুর্থ বর্ষে অবস্থান করছি আমরা অল্প কিছুদিনের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করবো। সবার পরিবার সংগতি উচ্চবিত্তদের মত না। সেক্ষেত্রে আমাদের পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, এভাবে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে ঘরে বসে থেকে। অথচ সরকারি সার্কুলার ঠিকই দিচ্ছে।
যে সকল শিক্ষার্থী ফাইনাল ইয়ারে আছেন, তাদের সমস্যা সব চেয়ে বেশি হবে। তাদের কোমর এমন ভাবে ভেঙে যাবে যে, নতুন উদ্যমে পড়া লেখা করার সাহস সঞ্চয় করতে সক্ষম হবেন না। যদি সক্ষম হন তবে ততদিনে অনেক বেশি সময় নষ্ট হয়ে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া লেখা কেবল বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে হয় না। কেবল বিসিএস-ই একজন শিক্ষার্থীর টার্গেট তা কিন্তু নয়। বরং বহু শিক্ষার্থী আছেন যারা বিদেশে পড়া লেখা করার স্বপ্ন বুনেছেন।
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনাকে পুঁজি করে শিক্ষা-কার্যক্রম বন্ধ রাখেনি। তারা যথাযথ ব্যবস্থা করে সেমিস্টার শেষ করেছে। সামনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এডমিশরের আবেদন শুরু হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের যে সকল শিক্ষার্থী এ সময় বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিতে আবেদন করার কথা ভেবেছে, তারা তা করতে পারবে না। কারণ তার সেমিস্টার শেষ হয়নি, ফলাফল আসেনি। ফলে কি হবে? এ সকল শিক্ষার্থীর বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। তারা তাদের সহপাঠী হওয়ার কথা ছিলো। তারা সিনিয়র হয়ে যাবে।
তখন দেখা যাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েগুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে এমনিই একবছর পিছিয়ে যাবে। নভেম্বর-ডিসেম্বর যে সকল শিক্ষার্থী বাহিরে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো তার এই ফল মিস করবে। ফলে অযথা সময় নষ্ট হওয়াতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে।
দেখুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি একদিকে যেমন ধীরগতি, অন্যদিকে তেমনিই সুদূরপ্রসারী। আর তাই দীর্ঘ এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব হয়তো এখন আমারা পরিমাপ করতে পারছি না। তাই বলে এটা যে অনুপস্থিত, এমনটা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। একটু ভাবুন তো, একটি স্কুল পড়ুয়া ছেলে বা মেয়ে কিভাবে দীর্ঘ ১২ মাস পার করল। শহরে না হয় অনলাইনের কল্যাণে স্কুলের সঙ্গে ছাত্র ছাত্রীরা সংযুক্ত আছে। কিন্তু লাখ লাখ ছাত্র ছাত্রী যারা গ্রামে বাস করে, তাদের কথা কি কখনো ভেবে দেখেছি? বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানেরা হয়তো আর স্কুলে ফিরতে পারবে না। অনেকেই হয়তো উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের বেশির ভাগ মুঠোফোনসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়েছে। আর এর সামাজিক ক্ষতির দিকগুলো একটু ভাবুন তো? তারা স্কুলে ফিরলেও তাদের শিক্ষার মান কি রকম হবে, তা ও সহজেই অনুমেয়।
দীর্ঘদিন বন্ধে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে আত্মহত্যা অপরাধ প্রবণতা, অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। সামাজিক অনাচার শিকার হচ্ছে মেয়ে শিক্ষার্থী। তাদের ওপর সহিংসতা ও অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তারা কোনও উপায় না পেয়ে আত্মহত্যা পথ বেছে নিয়েছে। তাই আমার মনে হয়, দেশের সবকিছু যেহেতু স্বাভাবিক তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হোক। এভাবে আর কতদিন???
ববিতা সুলতানা
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়